পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত: কেন আর কীভাবে করা হয়? Postmortem: Why and how is it done?

0 Shares
0
0
0

অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর কারণ জানার যে চেষ্টা করা হয়, তাকেই পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত বলা হয়। পোস্টমর্টেম শব্দটি অটোপসি, নিক্রোপসি ইত্যাদি দ্বারাও বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়েকশো ময়না তদন্ত হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতালে আলাদা আলাদাভাবে সেটি হওয়ায় এর মোট সংখ্যাটি কারো জানা নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে মূলত মৃত্যুর কারণ জানার জন্যই পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত করা হয়। কোন ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে বা তার মৃত্যু নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরি হলে, মৃত্যুর সঠিক কারণটি জানার জন্য মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয়, ঠিক কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে।

অনেক সময় শরীরের ভেতরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখা হয়। যেমন ধর্ষণের অভিযোগে সিমেন সংগ্রহ করে ডিএনএ ম্যাচ করা হতে পারে। আবার আত্মহত্যার মতো অভিযোগে ভিসেরা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বোঝা যায় যে বিষপ্রয়োগের কোন ঘটনা ঘটেছে কী না। যখন কোন ব্যক্তি অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করার পরেও ওই মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, তখনও পোস্টমর্টেম করা হয় যা ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম নামে পরিচিত।

পোস্টমর্টেমের মাধ্যমে কীভাবে, কখন এবং কেন কেউ মারা গেছে সে সম্পর্কে দরকারী তথ্য সহজেই জানা যায়। কোনো রোগ কীভাবে ছড়ায় সে সম্পর্কেও আরও ভাল বোঝার জন্য পোস্টমর্টেম রোগ বিশেষজ্ঞদেরকে সহায়তা করে।

অটোপসি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ অটোপসিয়া থেকে। যার অর্থ মৃতদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার করার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে এই শব্দটির প্রচলন হয়ে আসছে। অপরদিকে, “পোস্ট-মর্টেম” শব্দটির পোস্ট অর্থাৎ ‘পরে’ এবং মর্টেম মানে ‘মৃত্যু’ এসেছে ল্যাটিন থেকে। এটি প্রথম রেকর্ড করা হয়েছিল ১৭৩৪ সালে।

বাংলা ময়নাতদন্ত শব্দের “ময়না” এসেছে আরবি বা ফার্সি বা উর্দু থেকে যার অর্থ হলো ভালো করে খোঁজা বা অনুসন্ধান করা। আর “তদন্ত” শব্দটি হলো সংস্কৃত শব্দ। এই দুই শব্দ মিলেই তৈরি বাংলা ময়নাতদন্ত যার মানে হলো সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করা।

প্রাচীন গ্রীস; ময়নাতদন্তের প্রাচীনতম রেকর্ডগুলি গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেন অফ পারগামামের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল, যিনি একজন রোগীর লক্ষণগুলি অধ্যয়ন করেছিলেন এবং শরীরের প্রভাবিত অংশ পরীক্ষা করেছিলেন।

হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার মতো যেকোনো অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত করা হয়ে থাকে। এ ধরনের ঘটনায় প্রথমেই পুলিশ একটি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। অর্থাৎ মৃতদেহ কী অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর মৃত্যু সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য ময়না তদন্ত করতে পাঠানো হয়। মর্গে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা সেই সুরতহাল প্রতিবেদন দেখে, প্রথমে মৃতদেহের বাহ্যিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেন। সেখানে কোন আঘাত বা ক্ষত আছে কিনা, ত্বক ও জিহ্বার রঙ ইত্যাদি দেখে প্রথম প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

এরপরে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভারসহ শরীরের ভেতরটা যাচাই করে দেখা হয়। ফলে শরীরের ভেতরে কোন আঘাত থাকলে, রক্তক্ষরণ বা বিষক্রিয়া থাকলে, সেটি চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন। কোথাও আঘাতের চিহ্ন থাকলে সেটি কীভাবে হয়েছে, তা ভালো করে যাচাই করা হয়। এই কাজটি করতে গিয়ে মৃতদেহের নানা অংশ কেটে দেখতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। এ সময় শরীরের নানা প্রত্যঙ্গও সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়ে থাকে।

ময়না তদন্ত শেষে মৃতদেহ আবার সেলাই করে আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। তবে শরীরের অভ্যন্তরীণ কোন কোন অংশ কেটে আরো পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারে পাঠানো হতে পারে।

ময়না তদন্তে বেশ কয়েকটি বিষয় জানার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বিষয় হলো মৃত্যু কীভাবে হয়েছে এবং কখন মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়া ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কিনা, আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে কিনা, বিষ খাওয়ানো হয়েছে কিনা, রক্তক্ষরণের কোন ঘটনা আছে কিনা- ইত্যাদি বিষয়ও ময়না তদন্তে বেরিয়ে আসে।

বাংলাদেশের ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজে মর্গ রয়েছে। সেখানে ময়না তদন্তের জন্য বিশেষ স্থান থাকে। সেখানে ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা ময়না তদন্ত করে থাকেন।এর বাইরে যেসব জেলা শহরে আড়াইশো শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে, সেখানে ময়না তদন্ত করা হয়ে থাকে। মেডিকেল কলেজগুলোয় ফরেনসিক বিভাগের অধ্যাপকরা ময়না তদন্ত করলেও, জেলা শহরে সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে আবাসিক সার্জনরা সেটা করে থাকেন। যত দ্রুত ময়না তদন্ত করা যাবে, তত ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। তবে অনেক সময় মৃত্যুর অনেক পরেও, দাফন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ সময় পরেও পুনরায় ময়না তদন্তের উদাহরণ রয়েছে।

মৃত্যুর কারণ জানার জন্য মূলত ময়না তদন্ত করা হলেও অন্যান্য কিছু কারণেও ময়নাতদন্ত করার প্রয়োজন হয়। উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে এর আরো কয়েকটি ভাগ রয়েছে। যেমন:

  • মেডিকেল: অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ জানতে এই ময়না তদন্ত করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি একটি প্রচলিত পদ্ধতি।
  • একাডেমিক: চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনার জন্য মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করা হয়ে থাকে।
  • ক্লিনিক্যাল: অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুর পরেও কারো মৃত্যু নিয়ে যদি বিতর্ক তৈরি হয়, তখন ক্লিনিক্যাল পোস্টমর্টেম করা হয়।

অনেক ক্ষেত্রেই মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা তার পরিবারের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে থাকে। তাছাড়া অনেক ধর্মই ময়নাতদন্তত করাকে নিরুৎসাহিত করে। তাই নিতান্তই ময়নাতদন্তের দরকার হলে তা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করাই শ্রেয়।

লেখকঃ খাদিজা আক্তার লাবনী
সম্পাদকঃ উম্মে সুরাইয়া

0 Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like
positive parenting

ইতিবাচক প্যারেন্টিং ও এর গুরুত্ব-Positive Parenting and it’s Important

আমরা সবাই আমাদের সন্তানের জন্য সবসময় ভালটা চাই, তাদের সার্বিক যত্ন চাই। অভিভাবক হিসাবে তাদের দিতে চাই আমাদের…
Read More