শতাব্দীর মহামারী – Pandemics of centuries

0 Shares
0
0
0

SARS-CoV-2, কোভিড-১৯ বা নভেল করোনা ভাইরাস – ২০২০ সাল থেকে এক আতঙ্কের নাম। লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি আর ভাইরাসের দাপট থমকে দিয়েছিলো গোটা বিশ্বকে। কিন্তু মহামারী ব্যাপারটা পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিভিন্ন মহামারী যেমন গ্রাস করেছে অনেক প্রাণ, প্রজাতি বা সম্প্রদায় তেমনি ঘটিয়েছে অনেক ভালো পরিবর্তন। সেইরকম কিছু ভয়াবহ মহামারীর কথাই জানাবো আজকের লেখনীতে।

দ্যা জাস্টিনিয়ান প্লেগ

৫৪১ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে দেখা দেয়া জাস্টিনিয়ান প্লেগের উৎপত্তিস্থল হলো ইজিপ্ট। যা বাইজেন্টাইনের রাজধানী কন্সটান্টিনোপেলকে আক্রমণ করে ৫৪২ খ্রিস্টাব্দে। উত্তর আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চল থেকে কন্সটান্টিনোপেলে খাদ্যের যোগান আসত জলপথ দিয়ে। খাদ্য শস্যের সাথে সাথে কালো ইঁদুরও পাড়ি জমাতো রাজধানীতে আর এরাই ছিলো মূলত এই প্লেগ জীবাণুর বাহক। কন্সটান্টিনোপেলের ২০-৪০ ভাগ অধিবাসী এই রোগে প্রাণ হারায়। এই প্লেগ শুধু বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। যুদ্ধ এবং বাণিজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে এই প্লেগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপ জুড়ে। ধারণা করা হয়, তৎকালীন ইউরোপের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এই মহামারিতে আক্রান্ত হয় । বাইজেন্টাইন রাজধানীতে জাস্টিনিয়ান প্লেগের দাম্ভিকতা চার মাস অবধি থাকলেও বিশ্বজুড়ে এর আতংক থাকে প্রায় তিন শতাব্দী পর্যন্ত। 

দ্যা ব্ল্যাক ডেথ

মহামারীর ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত যে নাম তা হলো ব্ল্যাক ডেথ। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫২ সাল পর্যন্ত পৃথিবী দাপিয়ে বেরিয়েছিল এই রোগ যা পুরোপুরি নির্মূল হয় নি আজও। ব্ল্যাক ডেথ ছিলো মূলত এক ধরণের প্লেগ যার ফলে জ্বর এবং ব্যাথার সাথে সাথে ত্বক এবং ঘা কালো বর্ন ধারণ করতো। এক ধরণের ব্যাসিলাস ব্যাক্টেরিয়ার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায় যার প্রধান বাহক হলো ইঁদুরের শরীরে থাকা এক প্রকার মাছি। যুদ্ধ এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে এই প্লেগ মধ্য এশিয়াকে ছাড়িয়ে গ্রাস করে ইউরোপকে। মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা না জানা থাকলেও ধারণা করা হয় শুধু ইউরোপে ২৫-৩০ মিলিয়ন প্রাণ কেড়ে নেয় এই মহামারী। ব্ল্যাক ডেথের দরুন হওয়া বিশাল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইউরোপের সময় লেগেছিলো প্রায় ২০০ বছর।


ব্ল্যাক ডেথ ( Source: https://www.history.com)

কলেরা মহামারী (প্রথম)

পানিবাহিত রোগ কলেরার নাম সবারই জানা। কিন্তু প্রথম কলেরা মহামারী যার সময়কাল ছিলো ১৮১৭ থেকে ১৮২৪ সাল অবধি তার উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের যশোর সেটা কার জানা? অবশ্য তখন বাংলাদেশের জন্ম না হওয়ায় তা ভারত উপমহাদেশের যশোর নামেই পরিচিত ছিলো। ভিব্রিও কলেরা নামক ব্যাকটেরিয়া খাবার এবং পানির মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে দেহ থেকে সব লবণ পানি বের করে শরীরকে নিস্তেজ করে। ফলে মৃত্যু ঘটে। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা, ব্রিটেন, রাশিয়া, থাইল্যান্ড সহ বেশ কিছু দেশে। এতে মৃতের সংখ্যা দাড়ায় ১০০,০০০ এরও বেশি। উনিশ শতক ছাড়াও বিশ্বে আরো কয়েকবার এই কলেরা মহামারী হানা দেয় এবং এখনো প্রতি বছর কেড়ে নেয় বহু প্রাণ।

স্প্যানিশ ফ্লু 

‘মাস্ক পরুন, সুরক্ষিত থাকুন’- করোনার এই সময়ে খুবই জরুরি এই কথাটির বাস্তবায়ন হয়েছিলো আরো প্রায় ১০০ বছর আগে। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো এবং মৃতের সংখ্যা দাড়িয়েছিলো ২০-৫০ মিলিয়ন। জনসমাগম নিষিদ্ধ ছিল, মাস্ক ব্যবহার ছিলো বাধ্যতামূলক। শ্বাসতন্ত্রকে আক্রমণ করা এই অতি সংক্রামিত ফ্লু ভাইরাস সর্বপ্রথম দেখা দেয় ইউরোপে যা পরে যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়াকেও সংক্রমিত করে। মৃত্যুর সংখ্যা আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে এর ভয়াবহতা কমতে শুরু করে।

সঠিকভাবে হাত ধোয়ার ধাপসমূহ (Source: https://europeantissue.com)

এইডস 

১৯৮১ সালে পৃথিবী জুড়ে হঠাৎ এক নতুন আতঙ্কের নাম সৃষ্টি হয় যা হলো এইডস। এইচ আইভি (HIV) দ্বারা সৃষ্ট হওয়া এই রোগের প্রথম রোগী পাওয়া যায় আমেরিকায়। ধীরে ধীরে বিস্তার হয় নানান দেশে। এই ভাইরাস রক্তপ্রবাহ ও বডি ফ্লুইডে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয় যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিঃশেষ করে দেয়। ফলে রোগী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন এইডস রোগীর প্রাণহানি হয়েছে এবং প্রতিবছর নতুন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এইডসের এই ভয়াবহতার জন্য ডব্লিউএইচও (WHO) এইডস কে ‘গ্লোবাল এপিডেমিক’ হিসেবে বিবেচনা করেছে।

কোভিড-১৯

একবিংশ শতাব্দীর মহামারী কোভিড-১৯ সর্বপ্রথম দেখা যায় চীনের উহান শহরে যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, চীন- এর মতো উন্নত দেশগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এই নভেল করোনাকে সামাল দিতে।  ২০২০ সালের মার্চে ডব্লিউএইচও আনুষ্ঠানিকভাবে একে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেন। কোভিডের জন্য দায়ী সার্স (SARS) ভাইরাস কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বে বিদ্যমান তবে তার নতুন ধরণের স্ট্রেইন (SARS-CoV-2) দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো বিশ্বজুড়ে এবং নিজের মধ্যে আনছে নানাবিধ পরিবর্তন। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ প্রাণহানি প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন যা সামনে আরো বাড়বে। এর প্রতিকারে উন্নত দেশেগুলোতে চলছে গবেষণা। তবে প্রতিরোধ ব্যবস্থাটা অনেকটা স্প্যানিশ ফ্লুয়ের মতো। মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা- অনেকটাই কমাতে পারে এর বিস্তার।

যুগে যুগে এই মহামারীগুলো আমাদের শিখিয়ে গেছে কীভাবে ভালো অভ্যাসগুলোকে আয়ত্ত করতে হয়, ক্ষেত্র বিশেষে কমিয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, ঘটিয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিপ্লব, গবেষণার প্রসার, উপলব্ধি করিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা।

আর হ্যাঁ, কিছু ভারী ভারী মেডিকেল টার্মিনোলজিও তো শিখিয়েছে তাই না?

আর কোন মহামারীর ভয়াবহতা আপনার জানা? আমাদেরকেও জানান কমেন্ট বক্সে।

লেখকঃ উম্মে সুরাইয়া

Source:

0 Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like
post mortem

পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত: কেন আর কীভাবে করা হয়? Postmortem: Why and how is it done?

অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর কারণ জানার যে চেষ্টা করা হয়, তাকেই পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত বলা…
Read More
mosquito

ডেঙ্গু ভাইরাস, এর প্রাদুর্ভাব ও বাংলাদেশ-Dengue and it’s Outbreak in Bangladesh

ডেঙ্গু, একটি মশাবাহিত রোগ যা ২০০০ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান অসুস্থতা এবং মৃত্যুহারের কারণে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিতে…
Read More
positive parenting

ইতিবাচক প্যারেন্টিং ও এর গুরুত্ব-Positive Parenting and it’s Important

আমরা সবাই আমাদের সন্তানের জন্য সবসময় ভালটা চাই, তাদের সার্বিক যত্ন চাই। অভিভাবক হিসাবে তাদের দিতে চাই আমাদের…
Read More