জিনগত রোগ এবং বাংলাদেশ – Genetic Disorders and Bangladesh

0 Shares
0
0
0

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডায়রিয়া, কলেরা, ঠান্ডা জ্বর, পোলিও, জন্ডিস, বসন্ত – এসব সংক্রামক ব্যাধি খুবই পরিচিত। এর মধ্যে কিছু ব্যাধি কয়েক বছর আগেও ছিলো ভয়াবহ। কিন্তু এসব রোগকে ছাপিয়ে যে রোগ নীরব ঘাতকের মতো প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে সেগুলো হল বংশগত বা জিনগত রোগ। যার নেই স্থায়ী কোনো নিরাময় ব্যবস্থা। এই সম্পর্কে জ্ঞান, জনসচেতনতা কিংবা জনগণের মনোভাবও খুব নগণ্য। কিন্তু আমরা কি জানি ধীরে ধীরে বাংলাদেশ জিনগত রোগের চারণভূমি হয়ে উঠছে?

জিনগত রোগ কি?

ক্রোমোসোমে থাকা ডিএনএ অণুর বিশেষ অংশ যা কোনো জীবের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে সেটাই জিন। যেমন আপনার চোখের মনি কালো হবে না নীল, চুলের রঙ কালো নাকি ব্লন্ড, জন্ম থেকে আপনার রক্তশূন্যতা থাকবে কি না সবই নির্ধারিত থাকে জিনে। যে ভাষায় তা নির্ধারিত থাকে তাকে বলে জেনেটিক কোড। এই কোডগুলো যখন ঠিকভাবে না থাকে বা মিউটেশন ঘটে তখন জীবের বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ সুষ্ঠুভাবে হয় না। বংশগত বা পরিবেশগত কারণে এই কোডে ভুল (defective gene) থাকতে পারে। বংশগত হলে সেই ভুল জিনের জন্য যে রোগ হয় তাকেই আমরা বংশগত রোগ হিসেবে জানি।

মিউটেট জিন Source: https://24hoursofbiology.com

বাংলাদেশে জিনগত রোগ

সারাবিশ্বে ৬৫০০ এর বেশি জিনগত রোগ আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এধরণের রোগ গুলোর মধ্যে থ্যালাসেমিয়া, হৃদযন্ত্রের রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস অন্যতম। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশ “থ্যালাসেমিয়া বেল্ট”- এ অবস্থিত এবং এখানে প্রতি বছর প্রায় ৬০০০ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ধারণা করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের দেশে হৃদযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং বাংলাদেশের মৃত্যুহারের দিক দিয়ে ষষ্ঠ প্রধান কারণ হলো ক্যান্সার। পুরুষদের ফুসফুস ক্যান্সারে এবং মহিলাদের জরাযু ও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অহরহই দেখা যায়। পরিসংখ্যান মতে, এ দেশে এখন পর্যন্ত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা মোট ১.৩-১.৫ মিলিয়ন এবং প্রতি বছর ০.২ মিলিয়ন নতুন রোগী শনাক্ত হয়।

এর পিছনে কারণ

বাংলাদেশে জিনগত রোগের এরূপ চিত্রের অন্যতম কারণ হলো রক্তের সম্পর্ক আছে এমন নিকট আত্নীয়দের মধ্যে বিয়ে হওয়া (Consanguineous marriage)। যা শিশুমৃত্যুর হারকে এবং রোগের ব্যাপকতাকে দ্বিগুণ করেছে। তাছাড়া এক গবেষণায় এমন বিবাহ বন্ধনের সাথে শিশুর জন্মগত হৃদরোগের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে এরূপ বিবাহের প্রবলতা প্রায় ৬.৬৪%। অপর এক গবেষণা মতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিকট আত্নীয়দের মধ্যে বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি,প্রায় ১৭.৬% এবং চাঁদপুর জেলার মতলবে তা ৬.৭%।

জিনগত কারণের পাশাপাশি পরিবেশগত কারণেও রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। পানি দুষণ, বায়ূ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, জীবন ব্যবস্থা অনেকাংশেই রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। শ্বাস-প্রশ্বাস, পানি বা খাবারের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ আমাদের দেহে প্রবেশ করে জিনে নতুন ধরণের মিউটেশন ঘটাতে পারে, যার ফলে সৃষ্টি হতে পারে সম্পূর্ণ নতুন কোনো রোগের।

Source: townbuzz.blogspot.com

আমাদের করণীয়

কিছু জিনগত রোগের লক্ষন জন্মের সময় দেখা দিতে পারে, আবার কিছু কিছুর লক্ষন বয়সের সাথে সাথে প্রকাশ পায়। এসব রোগের স্থায়ী চিকিৎসা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ক্ষণস্থায়ী সুস্থতার জন্য রোগীদের নির্ভর করতে হয় আজীবন চিকিৎসা (life long treatment) এবং ওষুধপত্রের উপর যা খুবই ব্যয়বহুল। জিন থেরাপী এই সমস্যার সমাধান হিসেবে একটা সম্ভাবনার দ্বার হতে পারে তবে তা এখনও গবেষণার আওতায় রয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি। হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ গুলোতে শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে বিবাহ পূর্ববর্তী স্ক্রিনিং (premarital screening), রক্তের গ্রুপ যাচাই, জেনেটিক কাউন্সিলিং এর মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্যের বিস্তার করতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন আইন তৈরি এবং তার প্রয়োগ খুবই কার্যকরী হতে পারে।

সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ, জীবন ব্যবস্থার এবং পরিবেশের পরিবর্তন – এসব কারণে দেশে জিনগত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই ঊর্ধগতিকে থামাতে হলে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, গবেষক সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে।

লেখকঃ উম্মে সুরাইয়া

Source:

  1. Genetic disorders: Definition, development, and examples (medicalnewstoday.com)
  2. Mutation Spectrum of β-Thalassemia and Other Hemoglobinopathies in Chittagong, Southeast Bangladesh: Hemoglobin: Vol 39, No 6 (tandfonline.com)
  3. Genetic counseling in the context of Bangladesh: current scenario, challenges, and a framework for genetic service implementation | Orphanet Journal of Rare Diseases | Full Text (biomedcentral.com)
0 Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like

হাতের তালু ও পায়ের পাতায় অতিরিক্ত ঘাম – Hyperhidrosis (Sweaty Hands Syndrome)

ভোটার আইডি কার্ড করবেন অথবা সিমের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করবেন, চাই আপনার আঙুলের ছাপ। কিন্তু মেশিন ঠিক থাকার পরেও…
Read More