কালার ব্লাইন্ড এর সম্পর্কে আমাদের দেশে অনেকে জানেনা। কালার ব্লাইন্ড নামের চোখের রোগটা আমাদের দেশে ততটা পরিচিত না। কালার ব্লাইন্ড এর অর্থ হল বর্ণান্ধতা বা বর্ণান্ধত্ব বা বর্ণবৈকল্য। মানুষের, কতিপয় রঙ দেখার, শনাক্ত করার বা তাদের মধ্যে পার্থক্য করার অক্ষমতাজনিত এক প্রকার শারীরিক বৈকল্য তাকে বর্ণান্ধতা বলে।
এমন অনেক মানুষ আছে যারা সাধারণ দৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে থাকে কিন্তু আমাদের চারপাশে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা অসাধারণ দৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সাধারণ দৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ সবুজ রঙকে সবুজই দেখেবে কিন্তু অসাধারণ দৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ সবুজ রঙকে সবুজ না দেখে নীল দেখবে। কিছু বঞ্চিত মানুষজন রয়েছেন যারা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো পৃথিবীর সব রং দেখতে পান না। অনেক রকমের রং উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত এইসব মানুষই কালার ব্লাইন্ড বা বর্ণান্ধ।
মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় কালার ব্লাইন্ড কী?
কালার ব্লাইন্ডনেস হল চোখের দৃষ্টিশক্তির এমন একটি অবস্থা যখন আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক আলোতে বিশেষ কিছু রঙের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পান না। নীল, সবুজ, হলুদ বা লাল রং আলাদা করে চেনা কিংবা এইসব রঙের সংমিশ্রণ রয়েছে এমন রং দেখে বুঝতে পারা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। মূল রংটি আসলে কি সেটি বুঝতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়। আবার মজার ব্যাপার হল অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তারা ভুল রং দেখছেন | মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় এইসব মানুষই কালার ব্লাইন্ড। এইটির অন্য একটি নামও আছে আর তা হল “কালার ভিশন ডেফিসিয়েন্সি” (CVD)।
কালার ব্লাইন্ড কেন হয় ?
বায়োলজি আর জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। কালার ব্লাইন্ড হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই বলা যায় চোখের রেটিনার “রড” (Rod) আর “কোন” (Cone) কোষ দ্বারা সম্পর্কিত |
মানুষের চোখের ভিতরে রেটিনা নামক একটি পাতলা স্তর রয়েছে যেটি দুই ধরনের আলোকসংবেদী কোষ বা ফটোরিসেপ্টর (Photoreceptor) বহন করে থাকে । এদের নাম হল রডকোষ এবং কোনকোষ। কোনকোষ আমাদের বিভিন্ন রং চেনাতে সাহায্য করে এবং এই কোষের মাধ্যমেই আমরা বিভিন্ন রঙের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারি। অর্থাৎ আমরা চারপাশে রঙিন যা কিছু দেখি সবই কোনকোষের অবদানের মাধ্যমে । আর অপরদিকে রডকোষগুলো আমাদেরকে আলো শনাক্ত করতে এবং আলোর ধরন বুঝতে সাহায্য করে কিন্তু রং চেনানোর ব্যাপারে রডকোষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
কালার ব্লাইন্ড হওয়াটা কোনকোষের মাধ্যমে হয়ে থাকে? আমাদের চোখে তিন ধরনের কোন কোষ রয়েছে। এই তিন ধরনের কোনকোষ তিনটি মৌলিক রং শনাক্ত করতে পারে। এরা হল লাল, সবুজ ও নীল। চোখের রেটিনায় কোনোভাবে যদি এই তিন রকমের কোনকোষের যেকোনো একটির ঘাটতি দেখা যায় তাহলেই কালার ব্লাইন্ডনেস তৈরি হয়। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় যখন কোনো ব্যক্তির চোখের রেটিনায় এই তিন রকমের কোনকোষই অনুপস্থিত থাকে। এই ধরনের সমস্যার কারণে সব রঙই ধূসর বা সাদা-কালো দেখবে। এমনকি রক্তের রঙও সাদা কালো দেখবে।
বর্ণান্ধতা কেন হয়? জেনেটিক নাকি বংশগত কোনো কারণে?
কালার ব্লাইন্ড হওয়ার পেছনে জেনেটিক আর বংশগত- উভয় কারণই রয়েছে |
জেনেটিক কারণ
সাধারণত নারীদের থেকে পুরুষদের কালার ব্লাইন্ড হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। আর পুরো ব্যাপারটাই Inheritance of sex–linked genes এর কারণে হয়ে থাকে।
জেনেটিক সায়েন্সের ভাষায়, প্রত্যেক পুরুষের সেক্স ক্রোমোজোম XY ধরনের হয়ে থাকে আর প্রত্যেক নারীর ক্ষেত্রে সেক্স ক্রোমোজোমের গঠন হচ্ছে XX।
আর জেনেটিক সায়েন্সের মতে, লাল আর সবুজ রঙের রিসেপ্টরের জন্য যেই জিন নারী বা পুরুষ উভয়ের জন্যই রয়েছে সেটির অবস্থান X ক্রোমোজোমে। কালার ব্লাইন্ড হওয়ার পেছনে X ক্রোমোজোমের এই রিসেপ্টর জিনকেই দায়ী করা যায়। যেহেতু পুরুষের সেক্স ক্রোমোজোমে একটি মাত্র X ক্রোমোজোম থাকে, তাই কোনোভাবে যদি এই X ক্রোমোজোমের জেনেটিক কোডে কোনোরকম ব্যাঘাত ঘটে তাহলে X ক্রোমোজোমটির আর কোনো ব্যাকআপ থাকে না। আর এই ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক কোডের কারণেই পুরুষদের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের বর্ণান্ধতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। অপরদিকে নারীদের সেক্স ক্রোমোজোমের দুইটি X ক্রোমোজোম থাকায় একটি X ক্রোমোজোমের জেনেটিক ব্যাঘাত ঘটলেও অন্য X ক্রোমোজোমটি ব্যাকআপ দিতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে দুইটি X ক্রোমোজোমেরই জেনেটিক কোডে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা কম। তাই এই ক্ষেত্রে কালার ব্লাইন্ড এর সংখ্যাটাও তুলনামুলক ভাবে কম। আর এটাই কালার ব্লাইন্ড হওয়ার জেনেটিক কারণ।
বংশগত কারণ
বংশগত কারণেও কিন্তু কালার ব্লাইন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন ধরা যাক কোনো বাবা-মা উভয়ই কালার ব্লাইন্ড। বাবা-মায়ের যদি কোনো মেয়ে সন্তান থাকে তাহলে মেয়েটির কালার ব্লাইন্ড হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। কারণ মেয়েটির বাবা-মা উভয়ের X ক্রোমোজোমের জেনেটিক কোডে ব্যাঘাত ঘটার ফলে কালার রিসেপ্টর অনুপস্থিত। আর মেয়েটির ক্রোমোজোমের গঠন যেহেতু তার বাবা এবং মায়ের থেকে একটি করে X ক্রোমোজোম নিয়ে গঠিত (XX) , সেক্ষেত্রে মেয়েটির ক্রোমোজোমের গঠনেও কালার রিসেপ্টর অনুপস্থিত। তাই মেয়েটির কালার ব্লাইন্ড হওয়ার সম্ভাবনাও শতভাগ। এই X ক্রোমোজোমের লেনদেনের ফলেই কিন্তু বংশগত কারণে কালার ব্লাইন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বংশগত ও জেনেটিক কারণ ছাড়াও কালার ব্লাইন্ড হওয়ার অন্য কারণ থাকতে পারে। যেমনঃ
- কোনো ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে।
- গুরুতর আঘাত পাওয়ার ফলে।
- চোখে ছানি পড়ার কারণে।
- পারকিনসন রোগের কারণে।
- ভিটামিন A এর অভাবে।
- এছাড়া বার্ধক্যজনিত কারণে কালার ব্লাইন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- বাংলাদেশের শীর্ষ ১০টি সফটওয়্যার কোম্পানি।
- ১০ টি খাবার যা বিড়ালকে জন্য হতে পারে ক্ষতিকর ?
- বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ টি অনলাইন খাদ্য বিতরণ পরিষেবা ।
- বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ টি ই-লার্নিং ওয়েবসাইট এবং শিক্ষামূলক অ্যাপ
- সেরা ১০টি বাংলাদেশী খাবার
কালার ব্লাইন্ড এর প্রকারভেদ
কালার ব্লাইন্ডনেস তিন ধরনের হতে পারে। যেমনঃ
- লাল-সবুজ কালার ব্লাইন্ডনেস
- নীল-হলুদ কালার ব্লাইন্ডনেস
- কমপ্লিট কালার ব্লাইন্ডনেসে
লাল-সবুজ কালার ব্লাইন্ডনেস
এই ধরণের সমস্যা কয়েক রকমের হতে পারে। যেমনঃ প্রোটানোপিয়া (Protanopia), ডিউটেরানোপিয়া (Deuteranopia), প্রোটানোমালি (Protanomaly), এবং ডিউটেরানোমেলি (Deuteranomaly)। কোনো ব্যক্তি লাল আর সবুজ রং আলাদা করে বুঝতে না পারলে বা লাল আর সবুজ রং দুইটি চিনতে না পারলে তিনি এই ধরণের কালার ব্লাইন্ডনেসে ভুগছেন।
নীল-হলুদ কালার ব্লাইন্ডনেস
এই ধরনের কালার ব্লাইন্ডনেস দুই রকমের হয়। ট্রাইটানোপিয়া (Tritanopia) এবং ট্রাইটানোমালিতে (Tritanomaly) ভোগা মানুষজনদের নীলচে এবং সবুজাভ বর্ণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অসুবিধা হয়। এছাড়াও সবুজাভ-হলুদ রং চিনতে এদের বেশ বেগ পেতে হয়
কমপ্লিট কালার ব্লাইন্ডনেসে
এই ধরনের মানুষজনের দুনিয়ায় সাদা,কালো আর ধূসর রং ছাড়া আর কোনো রঙ তাঁরা দেখতে পান না! তাদের কাছে পুরো জীবনটাই রঙিন ছবির সাদা-কালো স্কেচের মতো।
যে সকল খ্যাত বিখ্যাত মানুষরা কালার ব্লাইন্ড ছিলেন বা আছেন তা নিম্নরুপ :
- দা ডার্ক নাইট, ইন্টারস্টেলার, ইন্সেপশন কিংবা দা প্রেস্টিজ- দুনিয়া কাঁপানো এই সব হলিউড মুভির পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান কিন্তু লাল-সবুজ কালার ব্লাইন্ড।
- ডিউক অফ ক্যামব্রিজ প্রিন্স উইলিয়াম
- যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন
- টম সয়্যার আর হাকল বেরি ফিনের দুঃসাহসিক অভিযানের জন্মদাতা মার্ক টোয়েন
- হলিউড অভিনেতা পল নিউমেন এবং কেনু রিভস
- ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ একজন লাল-সবুজ কালার ব্লাইন্ড ! একমাত্র নীল রঙটিই তিনি ভালো ভাবে দেখতে পারেন । সেই কারণেই ফেইসবুকের প্রায় প্রত্যেকটি জিনিসকেই তিনি নীল রং দিয়ে সাজিয়েছেন!
- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন কালার ব্লাইন্ড
- ফ্রেঞ্চ পেইন্টার অস্কার ক্লাউদে মনেট (Claude Monet) কালার ব্লাইন্ড হওয়া সত্ত্বেও অসাধারণ সব চিত্রশিল্পের জন্ম দিয়েছেন!
কালার ব্লাইন্ড চিকিৎসাঃ
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কালার ব্লাইন্ডনেসের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি। কিন্তু তাই বলে এই সমস্যার একেবারেই যে কোনো প্রতিকার নেই তা কিন্তু নয়। প্রতিনিয়ত কালার ব্লাইন্ডনেস নিয়ে গবেষণা হচ্ছে আর তার সাথে কালার ব্লাইন্ডদের রঙিন জীবন উপভোগ করার সম্ভাবনাও বাড়ছে। এই যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় এনক্রোমা নামক একটি প্রতিষ্ঠান কালার ব্লাইন্ডদের জন্য তৈরি করে ফেলেছে এনক্রোমা গ্লাস। কালার ব্লাইন্ড মানুষজন যাতে রঙের দেখা পায় সেই জন্যই তাদের এই প্রয়াস। তাদের চমৎকার কাজকর্ম আর দারুণ সব স্টাইলিস গ্লাসগুলো দেখতে ঘুরে আসতে পারেন https://enchroma.com এই লিঙ্কটিতে।
কালার ব্লাইন্ড টেস্ট
কালার ব্লাইন্ড টেস্টের একটি পদ্ধিতিটির নাম “ইশিহারা”(Ishihara) কালার টেস্ট। টোকিও ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর ড. শিনবু ইশিহারা ১৯১৭ সালে সর্বপ্রথম এই ধরনের কালার ব্লাইন্ড টেস্টের সূচনা করেন। এই পদ্ধতিতে কতোগুলো অসমান সাইজের রঙিন ডট থেকে আপনাকে কোনো সংখ্যা বা অক্ষর খুঁজে বের করতে হবে।
কালার ব্লাইন্ড টেস্টের আরও একটি পদ্ধতি হচ্ছে ক্যামব্রিজ কালার টেস্ট (Cambridge color test)। পদ্ধতিটি অনেকটাই এক রকম, কিন্তু এইবার অসংখ্য রঙিন ডটের মধ্য থেকে ইংরেজি “C’’ অক্ষরটি খুঁজে বের করতে হয় এবং অক্ষরটি কোন অবস্থায় আছে সেটিও বলতে হয়।
কালার ব্লাইন্ড টেস্টের জন্য কিছু লিঙ্ক https://enchroma.com/pages/test এবং https://colormax.org/color-blind-test/ এই দুইটি লিঙ্কে। লিঙ্ক দুটিতে জনপ্রিয় ইশিহারা পদ্ধতিতে কালার ব্লাইন্ড টেস্ট করা হয়েছে।
ক্যামব্রিজ কালার টেস্ট করতে পারবেন এই লিঙ্কটিতে। লিঙ্কঃ https://colorlitelens.com/color-blindness-test.html#red-green
কিংবা এই ইউটিউব ভিডিওটি থেকেও কালার ব্লাইন্ড টেস্ট করে নেয়া যেতে পারে। লিঙ্কঃ https://youtu.be/CWyrp3hu4KE
টেস্টের ফলাফল স্বাভাবিক আসলে তো খুবই ভালো সংবাদ ! কিন্তু টেস্টে যদি আপনার কালার ব্লাইন্ডনেস ধরা পড়ে তাহলে হতাশ হবার কারণ নেই। কেননা কালার ব্লাইন্ড হয়ে ও অনেক মানুষ তার পরিশ্রম আর উদ্যমের সহয়তায় অর্জন করছে সফলতা।
Sources:
- https://en.wikipedia.org
- https://www.nei.nih.gov
- https://www.colourblindawareness.org
- https://www.womenshealthmag.com
লেখকঃ খাদিজা আক্তার লাবনী
সম্পাদকঃ উম্মে সুরাইয়া