কিডনি রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবছর দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যান কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে। শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না কীভাবে এর সঠিক যত্ন নিতে হয়, কীভাবে কিডনির ক্ষতি এড়িয়ে দৈনন্দিন জীবনযাপন করতে হয়। প্রতিদিনের জীবনে আমরা এমন অনেক কিছুই করি যা কিডনির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে |
মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গের নাম কিডনি (Kidney) বাংলায় যাকে বলে বৃক্ক। দেখতে দুটি শিমের আকৃতির মত। কিডনি আকারে এক একটি আমাদের হাতের মুষ্টির মত। মানুষের মেরুদণ্ডের প্রতিটি পাশে একটি করে পাঁজরের খাঁচার নীচে অবস্থিত| যার প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের রক্তকে পরিশোধিত করে প্রস্রাবের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ করা। কোন কারণে কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়লে শরীরে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই আজ আমরা এই কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করবো। জানতে পারবেন কিভাবে কিডনি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে নিজেকে সুস্থ্য করে তুলবেন।
ক্ষুধামান্দ্য, বমিভাব, বমি, পায়ে পানি আসা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া কিংবা অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের মতো কোনো একটি সমস্যা দিয়ে শুরু। অথবা দুর্বল অনুভব করা, নিজেকে বিবর্ণ দেখানোর মতো ‘মৃদু’ কোনো সমস্যায় ভোগা। অথচ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, কিডনির সমস্যার কথা। কিডনি রোগের মুশকিলটা এখানে। উপসর্গগুলো অত প্রকট নয় আর রুটিন চেকআপ ছাড়া শনাক্ত করা কঠিন।
কিডনির সমস্যা ধরা পড়লে শঙ্কিত হওয়ারই কথা। কিডনি মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের একটি। কিডনির রোগ মানেই কিন্তু জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। কিডনির সমস্যা হলেই ডায়ালাইসিস দরকার হবে কিংবা একবার ডায়ালাইসিস লাগলে প্রত্যেকেরই আজীবন ডায়ালাইসিস করাতে হয়, বিষয়গুলো এমনও নয়। কিডনি রোগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানা থাকলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হওয়া যায়।
কিডনি কীভাবে কাজ করে?
কিডনি মানবদেহের মূল অঙ্গগুলোর একটি। সুস্থ দেহের জন্য ও বেঁচে থাকার জন্য এটি অপরিহার্য অঙ্গ। কিডনি প্রধানত রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত পানি এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ শোধন করে। রক্তের পটেনশিয়াল অব হাইড্রোজেন ব্যালান্স (পিএইচ) বজায় রাখতেও কিডনি কার্যকরী ভুমিকা পালন করে, যা সুস্থ থাকার জন্য খুব জরুরি। এছাড়া কিডনির অন্যতম প্রধান কাজ হলো লবণ ও পটাশিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, হরমোন তৈরি করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, লাল রক্ত কোষের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা, এবং ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করা।
কিডনি সমস্যার প্রথম লক্ষণ কী?
প্রস্রাবে পরিবর্তন হওয়া কিডনি রোগের একটি বড় লক্ষণ। এ সময় প্রস্রাব কম বা বেশি হয়। প্রস্রাবের রংও গাঢ় হয়ে যায়। রাতের বেলা ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। অনেক সময় প্রস্রাবের বেগ অনুভব হলেও প্রস্রাব হয় না।
যে ৭ টি কারণে অসুস্থ হয়?
বিভিন্ন কারণে কিডনি অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
- কিডনি ফেইলর বা কিডনির বিকল
- ধীর গতির কিডনি বিকল
- কিডনিতে ইনফ্রেকশন বা প্রস্রাবের ইনফ্রেকশন
- উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ
- ডায়াবেটিসজনিত রোগ
- পাথরজনিত কিডনি রোগ
- প্রস্রাবে বাধাজনিত কারণে কিডনি রোগ ইত্যাদি।
কিডনি রোগ কেন হয় ?
ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিন ইনফেকশন, কিডনিতে পাথরসহ আরও অনেক কারণে কিডনি রোগ হয়। নিয়মিত পরিশ্রম বা অতিরিক্ত বিশ্রাম ও ব্যায়াম না করা, পানি না খাওয়া এবং ধূমপান করা হতে পারে এ রোগের কারণ। অনেক সময় পরিবারের কারও কাছ থেকে এই রোগ সং
কিডনিতে কি কি রোগ হয়?
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ
যখন আপনার কিডনির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে থাকে তখন রক্ত থেকে যে বর্জ্য তরল ফিল্টার করার ক্ষমতা থাকে তা হারিয়ে ফেলে এবং বর্জ্য আপনার শরীরে জমা হতে পারে এবং আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষতিন আপনার কিডনির কার্যকারিতা সময়ের সাথে আরও খারাপ হতে পারে এবং যখন আপনার কিডনি সম্পূর্ণরূপে কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তখন একে কিডনি ব্যর্থতা বা শেষ পর্যায়ের রেনাল ডিজিজ বলে।
কিডনি রোগের আরও ৮ টি ধরন রয়েছে। যেমনঃ
১। ফ্যাব্রি রোগঃ ফ্যাব্রি ডিজিজ একটি বিরল জেনেটিক রোগ যা আপনার পরিবারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এটি আপনার হৃদয়, মস্তিষ্ক এবং কিডনিসহ শরীরের চারপাশের অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে এবং তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম রক্ত প্রবাহিত হয়। সময়ের সাথে সাথে এটি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা কিডনি ব্যর্থতার কারণ হতে পারে।
২।সিস্টিনোসিসঃ সিস্টিনোসিস একটি বিরল ব্যাধি যা সিস্টাইন নামক একটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক আপনার শরীরে তৈরি হয় এবং স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। সিস্টিনোসিস থেকে কিডনির ক্ষতি কিডনি ব্যর্থ হতে পারে। সিস্টিনোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই তাদের সিস্টাইনের মাত্রা কমাতে ওষুধ খেতে হবে এবং তাদের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। সিস্টিনোসিস জেনেটিক রোগ এবং এটি প্রায়শই অল্পবয়সী শিশুদের মধ্যে নির্ণয় করা হয়।
৩। গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিসঃ গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিস হল যখন আপনার কিডনির ক্ষুদ্র ফিল্টার যা আপনার রক্ত (গ্লোমেরুলি) পরিষ্কার করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা রক্ত থেকে বর্জ্য তরলে অপসারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সময়ের সাথে সাথে এটি কিডনি ব্যর্থতার কারণ হতে পারে। অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিসের কারণে হতে পারে এবং এটি চিকিৎসা কারণের উপর নির্ভর করে।
৪। আইজিএ নেফ্রোপ্যাথিঃ আইজিএ নেফ্রোপ্যাথি এমন একটি রোগ যা আপনার ইমিউন সিস্টেম দ্বারা তৈরি হওয়া প্রোটিনগুলি আপনার কিডনিতে তৈরি করে এবং আপনার রক্ত (গ্লোমেরুলি) পরিষ্কার করে ক্ষুদ্র ফিল্টারগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষতির বিকাশ হতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে এবং আইজিএ নেফ্রোপ্যাথিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই জানেন না যে তাদের এটি আছে। আইজিএ নেফ্রোপ্যাথি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ এবং কিডনি ব্যর্থতা বা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। আইজিএ নেফ্রোপ্যাথির কোন নিরাময় নেই কিন্তু ওষুধ আপনার কিডনির ক্ষতি কমাতে পারে।
৫। লুপাস নেফ্রাইটিসঃ লুপাস নেফ্রাইটিস হল একটি অটোইমিউন ডিজিজ (একটি রোগ যা আপনার শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে তার নিজের টিস্যুতে আক্রমণ করে) যা কিডনিসহ আপনার পুরো শরীরে ব্যথা, ফুলে যাওয়া এবং ক্ষতির দিকে পরিচালিত করে। এটি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা কিডনি ব্যর্থতা হতে পারে। লুপাস নেফ্রাইটিসের সঠিক কারণ অজানা এবং এটি নিরাময় করা যায় না, তবে চিকিৎসা মাধ্যমে লুপাস আক্রান্ত অনেক লোক তাদের লক্ষণগুলি কমাতে পারে এবং গুরুতর কিডনির ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারে।
৬। এএইচইউএস (অ্যাটিপিকাল হেমোলাইটিক ইউরেমিক সিনড্রোম)ঃ এটি খুব বিরল জেনেটিক রোগ যা আপনার শরীরের ছোট রক্তনালীতে ক্ষুদ্র রক্ত জমাট বাঁধে এবং এই জমাটগুলি আপনার কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গগুলিতে রক্ত প্রবাহকে বাধা দিতে পারে এবং ক্ষতির কারণ হতে পারে। এএইচইউএস আছে এমন অনেক লোকের কখনও লক্ষণ দেখা যায় না।
৭। পলিসিস্টিক কিডনি রোগঃ পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ হল একটি জেনেটিক ব্যাধি যা আপনার কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গে সিস্ট যা তরল দিয়ে পূর্ণ করে। এই সিস্টগুলি আপনার রক্ত থেকে তরল এবং বর্জ্য ফিল্টার করার জন্য আপনার কিডনির ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। সময়ের সাথে সাথএ এই রোগ কিডনি ব্যর্থতার কারণ হতে পারে। এ রোগের জন্য কোনো নিরাময় নেই তবে চিকিৎসার মাধ্যমে সিস্টের বৃদ্ধিকে ধীর করে দিতে পারে ।
৮। বিরল রোগঃ অন্যান্য বিরল রোগ আছে যা আপনার কিডনির ক্ষতি করতে পারে এবং আপনার রক্ত থেকে বর্জ্য এবং তরল ফিল্টার করার ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এই ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা কিডনি ব্যর্থতা হতে পারে।
কিডনি রোগের ১০ টি লক্ষণ
কিডনি রোগের প্রধান সমস্যা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায় না। কিডনির কার্য ক্ষমতা কমতে থাকলে, ধীরে ধীরে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।
জেনে নিন কিডনি রোগের প্রধান উপসর্গগুলো-
- প্রস্রাব কম/বেশি হওয়া ও প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া
- প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হওয়া
- ওজন কমে যাওয়া
- শরীরের বিভিন্ন অংশে (হাত, পা, মুখ) পানি জমে ফুলে যাওয়া
- মনোযোগ কমে যাওয়া
- শরীরে ক্লান্তিভাব আসা ও বমি বমি ভাব হওয়া
- সবসময় শীত শীত লাগা
- মাঝে মাঝেই মাথাব্যথা হওয়া
- শরীরের বিভিন্ন অংশে চুলকানি বা র্যাশ হওয়া
- উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে।
তাছাড়া কিছু রোগ আছে যা থাকলে তাদের অবশ্যই কিডনি পরীক্ষা করতে হবে। যেমনঃ যদি ডায়াবেটিক থাকে, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, কখনও যদি মুখমন্ড ফুলে গিয়ে থাকে, যদি কারও ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, এমন কোন মানুষ যদি থাকে যে খুব বেশি হাটাচলা করে বা না বসে বসে কাজ করেন আবার কোন করণে দীর্ঘদিন ব্যথার ঔষুধ খেতে হয়েছে এবং যারা পানি কম পানে অভ্যস্থ, বংশে যদি কারও কিডনি রোগ থাকে এসব ইতিহাস থাকলে বছরে অন্তত দুইবার কিডনি পরীক্ষা করানো উচিৎ।
কিডনির সমস্যা বোঝার ৭ টি উপায়
অজান্তেই ভেতরে ভেতরে সব শেষ করে দেয় বলে কিডনির সমস্যাকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়। কিডনির সমস্যা দেখা দিলে শরীরে আরো বেশ কিছু রোগের প্রকোপ বাড়ে। এগুলোর ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানিও ঘটতে পারে। যেসব উপসর্গ দেখলে কিডনির সমস্যা বোঝা যাবে, সেগুলো জেনে রাখা খুব জরুরি। ৭ টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণেই ধারনা করা যাবে আপনার শরীরে কিডনি রোগ বাসা বেঁধেছে কি না |
জেনে নিন লক্ষণগুলো-
- বারবার মূত্রত্যাগ, মূত্রের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া বা মূত্রে অতিরিক্ত ফেনা হওয়া
- পিঠের নিচের অংশে ব্যথা হওয়া
- ত্বকে চুলকানি ও র্যাশ হওয়া
- গরম আবহাওয়ার মধ্যে শীত অনুভূত হওয়া
- শ্বাসকষ্ট হওয়া
- মুখ, চোখের চারপাশ ও পায়ের গোড়ালি ফুলে যাওয়া
- খাবারে অরুচি ও মুখে দুর্গন্ধ হওয়া।
বিভিন্ন কারণে কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে একজন মানুষ নানাবিধ শারীরিক জটিলতার মুখে পড়েন। এ রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়গুলো জানা থাকলে অনেক সময় সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা, জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনলে জটিলতা অনেকক্ষেত্রেই এড়ানো যায়।
কিডনি রোগ প্রতিরোধে ১০ টি উপায়
কিডনি রোগের অন্যতম ঝুঁকির কারণ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ। একটু সচেতন থাকলেই দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
জেনে নিন কিডনি রোগ প্রতিরোধে করণীয়-
- ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকলে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- নিয়মিত হাঁটুন বা শারীরিক পরিশ্রম করুন
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলুন
- ধূমপানের অভ্যাস থাকলে ত্যাগ করুন
- খাবার পাতে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন
- রক্তে কোলেস্টেরল স্বাভাবিক মাত্রায় রাখুন
- প্রতিদিন বেশি পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করুন
- কিডনি রোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ফলমূল খাবেন না
- কিডনি রোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ঔষধ খাবেন
- কিডনির সমস্যায় নিয়মিত রুটিন চেকআপ করানো আবশ্যক।
কিডনি রোগের চিকিৎসা
- নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ঔষধ গ্রহণ।
- সুষম খাবার খাওয়া, অনেক সময় কিডনি রোগের কারনে ডাক্তার নানান রকম খাবারে বিধিনিষেধ দিয়ে দেন, সেগুলো মানতে হবে।
- শারিরিকভাবে সক্রিয় থাকা, খুব জটিল কিডনি সমস্যা না থাকলে সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট করে এক্সারসাইজ করতে হবে।
- রাতে কমপক্ষে ৬ ঘন্টা পর্যাপ্ত ঘুম
- সিগারেট, জর্দা, ফাস্টফুড, এলকোহল ইত্যাদি বদভ্যাস পরিহার
- ব্যথার ঔষদ সেবনে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে সার্জারি লাগতে পারে।
- জটিল কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস করতে হয়।
কিডনী রোগের পরীক্ষাসমূহ
কোনো ব্যক্তি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা তা কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা তা শনাক্ত করতে পারি। যে কোনো ল্যাবরেটরিতেই এই পরীক্ষাগুলো করানো সম্ভব। সাধারণত এই তিনটি জিনিস পরীক্ষা করতে হয়।
১। প্রস্রাবের পরীক্ষাঃ প্রস্রাবের মাধ্যমে কোনো প্রোটিন বা এলবুমিন যাচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। যদি বেশি পরিমাণে প্রোটিন না যায়, সেক্ষেত্রে দেখতে হবে যে স্বল্প পরিমাণে তা যাচ্ছে কি না একে মাইক্রো অ্যালবুমিন বলা হয়। মাইক্রো অ্যালবুমিন উন্নত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা হয় এবং এটি পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন থেকে মাইক্রো অ্যালবুমিন যাওয়া শুরু হয়েছে, ঠিক সেই সময় থেকে যদি চিকিৎসা করা যায় তবে কিডনি রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় যাবে এবং কিডনি বিকল থেকে রক্ষা পাওয়াও যাবে। এই জন্যেই মাইক্রো অ্যালবুমিনকে বলা হয়, কিডনি রোগের অশনি সংকেত। উচ্চ রক্ত চাপের বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে মাইক্রো অ্যালবুমিন ইউরিয়া বা প্রস্রাবে মাইক্রো অ্যালবুমিন যাওয়া রোগের চিকিৎসা করা যায়।
২। রক্তের পরীক্ষাঃ রক্তের একটা উপাদান হলো ক্রিয়েটিনিন। রক্তে ক্রিয়েটিননের পরিমাণ, রোগীর উচ্চতা, বয়স ও ওজন এই কয়টি হিসাব থেকে একটি সমীকরণের মাধ্যমে কিডনি রোগের বিভিন্ন পর্যায় ভাগ করা হয়। যা ১০০ ভাগের মধ্যে কিডনি কতো ভাগ কাজ করছে, তার উপর ভিত্তি করে কিডনি রোগীদেরকে পাঁচটি পর্যায়ে বা স্টেজ-এ ভাগ করা যায় তা নিম্নরুপঃ
- ১ম পর্যায় যাদের কিডনি কার্যকারিতা ৯০ ভাগের ওপরে।
- ২য় পর্যায় কিডনির কার্যকারিতা ৬০-৮৯ ভাগ।
- ৩য় পর্যায় ৩০-৫৯ ভাগ।
- ৪র্থ পর্যায় ১৫-২৯ ভাগ।
- ৫ম পর্যায় যাদের কিডনির কার্যকারিতা ১৫ ভাগের নিচে।
যারা এই পঞ্চম পর্যায়ের রোগী তাদের ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হলো ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন করা। এইজন্যেই রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে এই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী কোন পর্যায়ে আছে তা বের করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করালে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যেতে পারে। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ের রোগীরাও চিকিৎসার ফলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। ৪র্থ পর্যায়ের রোগীদের পুরোপুরি নিরাময় না করা গেলেও কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কাজেই এই পরীক্ষাগুলো রোগ শনাক্ত করে তা প্রতিরোধ করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩।অন্যান্য পরীক্ষাঃ কিডনিতে পাথর বা প্রস্রাবে বাধাজনিত রোগ থাকলে তা শনাক্ত করার জন্যে আলট্রসনোগ্রাফি করা হয়ে থাকে।
কিডনি রোগীর যে সকল খাবার গ্রহণীয় ও বর্জনীয়
গ্রহণীয়
- যে সব ফল খাওয়া যাবে (প্রতিদিন যে কোনো এক প্রকারের ফল খাবেন ৫০ – ১০০ গ্রাম ) পেয়ারা ১/২, আপেল ১/২, নাসপাতি ১/২, পাকা পেপে ২-৪ টুকরা, কমলা ১/২, আনারস ২-৪ টুকরা, বেল |
- যে সব সবজি খাওয়া যাবে :ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, পটল, চালকুমড়া, ডাটা, লাউ, শশা |
- যে সব শাক খাওয়া যাবে : ডাটা শাক ,লাউ শাক, কলমি শাক, লাল শাক ৷
- যে সব সবজি সিদ্ধ করে পানি ফেলে রান্না করতে হবে : মিষ্টি কুমড়া , আলু , কাঁচা পেপে, কাঁচা কলা, করলা, গাজার, টমেটো, মুলা |
বর্জনীয়
- যে সব সবজি বাদ দিতে হবে :সজনে ,ঢেঁড়শ, বরবটি, কচু, মিষ্টি আলু ,পালং শাক, পুঁই শাক, ধনে পাতা |
- যে সব ফল খাওয়া যাবে না :কলা ,কামরাঙ্গা, আনার, লেবু, আমরা, বড়োই, পাকা আম, কাঁঠাল |
- যেসব খাবার বাদ দিতে হবে : বিভিন্ন প্রকার ডাল, শুকনা ফল ,বাদাম, কাজু বাদাম, খেজুর ও বিচি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে | ডাবের পানি ও নারিকেলের তৈরি খাবার বাদ দিতে হবে | গরু,খাসি, ভেড়া, মহিষ এদের মগজ, কলিজা, মাংস, সামুদ্রিক মাছ, সামুদ্রিক মাছের ডিম্, চিংড়ি বাদ দিতে হবে | লবণের তৈরি যেসব খাবার বাদ দিতে হবে : ( চিপস, আচার, চানাচুর, শুটকি, পনির ) সকল প্রকার ফর্মুলা এর খাদ্য- হরলিক্স,কমপ্লান কোমল পানীয় (কোক,সেভনআপ,) |
কিডনি ট্রান্সপারেন্ট রোগীর যে সকল খাদ্য গ্রহণীয় ও বর্জনীয়
যে সব খাবার গ্রহণ করবেন :
- পর্যাপ্ত পরিমানে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে (কমপক্ষে ৪-৫ লিটার )
- মুরগির চামড়া ছাড়া মাংস ,মাছ ,দুধ ও দই খাওয়া ভালো |
- হালকা লিকার চা খাওয়া যাবে |
- পর্যাপ্ত শাক ও সবজি খাওয়া ভালো |
- শাক সবজি রান্না করার আগে ভালোভাবে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে |
- খুব ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করুন এবং ঠান্ডা হবার পর খাবার খান |
- ফল খাবার আগে ভালোভাবে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে ফল খান | খোসায় আবৃত ফল যেমন কলা, আনার, কমলা নিরাপদে খাওয়া যাবে |
সাধারণ নির্দেশনা : খাবার আগে খাবারের পাত্র, গ্লাস ভালোভাবে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে জীবাণু মুক্ত করে নিন |
খাবারের জায়গা ও পরিবেশ পরিস্কার পরিছন্ন করে রাখুন |
যাত্ৰা পথে খাওয়ার জন্য প্যাকেট বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি, শুকনা গুড়, ডিম্ ভালো মত সিদ্ধ করে সাথে রাখুন |
খোলা জায়গা অথবা বাজারের কোনো খাবার খাওয়া ঠিক হবে না |
যে সব খাবার গ্রহণ করবেন না : অতিরিক্ত চিনি এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না |
চর্বি জাতীয় মাংস যেমন গরু,খাসির মাংস খাওয়া উচিত না |
দুধ চা,কফি খাওয়া যাবে না |
অতিরিক্ত তেল ,মসলা যুক্ত খাবার,ডুবো তেলে ভাজা খাবার না খাওয়াই ভালো |
পাউরুটি, পনির, মাখন, চিপস, কেক, প্যাস্ট্রি, কলিজা, মগজ, বড় চিংড়ি, মাছের মাথা , মাছের ডিম, আচার ,সয়াসস, টমেটো সস এবং সমস্ত নবণাক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো |
কাঁচা অথবা ভালোমতো সিদ্ধ না হওয়া খাবার খাবেন না | বিশেষ করে কম সিদ্ধ মাংস এবং কম সিদ্ধ ডিম খাবেন না |
ডায়ালাইসিস রোগীর যে সকল খাদ্য গ্রহণীয় ও বর্জনীয়
- প্রতিদিন যে কোনো এক প্রকেরের ফল খাওয়া যাবে (৫০ – ১০০ গ্রাম) : কম পটাশিয়াম যুক্ত ফল(পেয়ারা ১/২, আপেল ১/২, নাসপাতি ১/২, পাকা পেপে ২-৪ টুকরা, কমলা ১/২, পায়রা ১/২, আনারস ২-৪ টুকরা, বেল)খাওয়া যাবে |কম পটাশিয়াম যুক্ত সবজি খাওয়া যাবে : ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, পটল, চালকুমড়া, পটল, ডাটা, লাউ, শশা |যে সব শাক খাওয়া যাবে : ডাটা শাক ,লাউ শাক, কলমি শাক, লাল শাক |বেশি পানি দিয়া সিদ্ধ করে পানি ফেলে রান্না করতে হবে : উচ্চ পটাশিয়াম যুক্ত সবজি যেমন :মিষ্টি কুমড়া ,আলু ,কাঁচা পেপে,কাঁচা কলা,করলা,গাজার ,টমেটো ,মুলা লচিং পদ্ধতিতে অর্থাৎ বেশি পানি দিয়া সিদ্ধ করে পানি ফেলে রান্না করতে হবে |
- আমিষ জাতীয় খাবার বেশি পরিমানে খেতে হবে :মাছ, মাংস, ডিম্
- ফল কম খেতে হবে :উচ্চ পটাশিয়াম যুক্ত ফল যেমন : কলা, আঙ্গুর, কামরাঙ্গা, আনার, লেবু, আমরা, বড়োই, পাকা আম, কাঁঠাল কম খেতে হবে ৷
- উচ্চ ফসফেট যুক্ত খাবার কম খাওয়া ভালো:উচ্চ ফসফেট যুক্ত খাবার যেমন : দুধ,দুধের তৈরি খাবার, বিভিন্ন প্রকারের ডাল, বিচি জাতীয় খাবার এবং গরু,খাসির মাংস কম খাওয়া ভালো |
- উচ্চ সোডিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না : উচ্চ সোডিয়াম যুক্ত খাবার যেমন : লবন, ক্যান ফুড ,নাগগেটস ,সসেজ,নোনতা বিস্কুট,বিভিন্ন প্রকার সস ,পপকর্ন,আচার, চানাচুর,শুটকি মাছ খাওয়া যাবে না |
সাধারণ নির্দেশনা : নির্দিষ্ট পরিমানের বেশি পানি পান করা যাবে না |
তরল যে কিছু খাবেন (রং চা,দুধ ) নির্দিষ্ট পরিমানের ভিতর হতে হবে |
অতিরিক্ত তেল ও মসলা যুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না |
ধূমপান, সাদা পাতা , জর্দা পরিহার করতে হবে |
যে সব রোগী সপ্তহে ৮ ঘন্টা ডায়ালাইসিস নেন তাদের পটাশিয়াম ও অন্যানো খাবারের ক্ষেত্ৰে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে | তাদের অবশ্যই ডাক্তার এর পরামর্শ নিতে হবে |
কিডনিতে পাথর রোগী যে ১০ টি খাবার কম খাবেন
- দুধ ও দুধের তৈরি খাবার ,
- শুটকি মাছ ,
- কঁচু শাক ,
- চকলেট, চা, কফি,
- টমেটো, টমেটো সস ,
- আলু,
- বিট,
- পালং শাক,
- লবনাক্ত খাবার ,
- বাদাম, কাজু বাদাম ৷
প্রতিদিন এর নিয়মে একটু সচেতন ভাবে চলাচল করলে এবং একটু কষ্ট করে জীবনযাত্রার প্রণালি বদলে স্বাস্থ্যকর উপায়ে চলা যায়, তাহলে কিডনি বিকল হওয়ার এসব কারণ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব।